পহেলা বৈশাখ ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ
বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন কোন বাঙালির দ্বারা হয় নি বরং বাংলা সালের প্রবর্তন সম্রাট আকবর এর হাত ধরে শুরু হয়েছে। যাঁর পূর্ব পুরুষরা ছিলেন চেঙ্গিস খানের বংশধর। একবিংশ শতাব্দীর বাসিন্দা হয়ে যারা বাংলা নববর্ষের ভেতরে হিন্দুত্ববাদী তত্ত্বের তালাশ করেন তাদের অতন্ত দুঃখের সাথে জানাতে হয় ‘বাংলা নববর্ষ’ এর সাথে হিন্দুত্ব বা মুসলমানিত্ব কোনটিরই যোগসাজশ নেই।
মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরী সাল অনুযায়ী কৃষি খাজনা আদায় করা শুরু হলো।সে সময়, অসময়ে খাজনা দেওয়া কৃষকদের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পরে। দেখা যেত জমিদারের লোক যখন খাজনা নিতে আসত তখনও ফসল কাটা শুরু করেনি। তখন সম্রাটের আদেশ মত, তৎকালীন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজী সৌরবর্ষ ও আরবি হিজরী সালের উপর ভিত্তি করে বাংলা সাল ও তারিখ নির্ধারণ করেন। পুরো কাজটাই করা হয় ফসল উৎপাদনের ঋতুচক্রের সাথে সামঞ্জস্য রেখে। সম্রাট আকবর প্রাচীন বর্ষপঞ্জির সংস্কার আনেন। বাংলা মাসগুলোর নাম রাখা হয় নক্ষত্রের নাম অনুসারে। শুরুতে তারিখ ই এলাহীতে মাসের নাম গুলো ভিন্ন ছিল। মাসের দিনগুলোর জন্য একটি পৃথক নাম ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময় পৃথিবীর অন্যান্য পঞ্জিকার সপ্তাহ গণনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে সপ্তাহের সাত দিনের নাম করণ করা হয়। এখানেও গ্রহ-নক্ষত্রের নামানুসারেই দিনগুলোর নামকরণ করা হয়।
এখানে একটি গুরুত্ববহ প্রশ্ন উঠে আসে। সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রবর্তিত বাংলা সালকে হিন্দুদের ঐতিহ্য বলে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের বিরোধিতা করা যায় কি না ? যেটি আমাদের দেশে একটু কুচক্রী মহল বাজারে ঢালাও ভাবে প্রচার করে চলেছে।
পাকিস্তানি শোষণ, নিষ্পেষণের বিপরীতে ১৯৬০ এর দশক থেকে বাঙালির বর্ষবরণ উৎসব পরিণত হয় প্রতিবাদের নির্ভেজাল অস্ত্র হিসেবে। ধর্মের দ্বৈরথ প্রসূত সৃষ্ট পাকিস্তানের শাসকশ্রেণী তাদের শোষণ জারি রাখার ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে শুরু করে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর একের পর এক আক্রমণ। পাকিস্তানি হায়েনারা বাঙ্গালীদের বরাবরই হিন্দু প্রভাবিত নিচু জাতের মানুষ ভাবতো। বাঙালি সংস্কৃতি ও ভাষার সাথে হিন্দুত্বকে জড়িয়ে অত্যাচারকে জায়েজীকরণ করতো। বাংলা ভাষার বদলে উর্দু আরবি শব্দের বোঝা জোরপূর্বক চাপিয়ে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করা হয়েছিলো।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ঠিকই বুঝতে পেরেছিল বাংলা সাহিত্যের মহীরুহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে সমুদ্রসমান প্রেরণার উৎস। তাই রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতা প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। কবিগুরুকে নিষিদ্ধ করে পাকিস্তানী শাসক আইয়ুব খান। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাঙালির সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠে।
১৯৬১ সালে পূর্ব বাংলায় বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী উদযাপিত হয়। ঐ বছরই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে বাঙালি জাতি। এসব প্রতিবাদী আয়োজন এর অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ- বঙ্গবন্ধুর বাঙালি মানসপটে, তাঁর চিন্তার গভীরতম ভাবনার কিশলয়ে কিভাবে প্রেরণা জুগিয়ে ছিলেন তার একটি উদাহরণ হল- ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ঢাকায় ইডেন হোটেলে বাঙালি মুক্তির ঠিকানা- আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনের উদ্বোধন হয়েছিল, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাওয়ার মধ্য দিয়ে। আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিলে, আমাদের বাঁচার দাবি ৬ দফা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
শুধুমাত্র পাকিস্তানিদেরই নয় বরং তাদের সমমনা এদেশীয় দোসরদের বিরোধিতার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় প্রতিবাদী বৈশাখ উদযাপন। পহেলা বৈশাখ পরিণত হয় বাঙালি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পরশপাথর হিসেবে।
১৯৬৭ সাল থেকে রমনা বটমূলে ছায়ানটের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বৈশাখের পুনঃজাগরণ ঘটে। বাঙালির আধুনিক বর্ষবরণ উদযাপনে শুরু থেকে যারা অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ওয়াহিদুল হক এবং ডা.সনজিদা খাতুন। স্বাধিকার আন্দোলনের সময় ‘ছায়ানট’ গানে গানে যে প্রতিবাদের অমর ধারা সৃষ্টি করেছিল তা মুক্তি সংগ্রামে আমাদেরকে দৈব সাহস-শক্তি-প্রেরণার সাথে সাক্ষাত করিয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের মূল পরিচয় যে বাঙালি সেটিরও নির্ভীক উপলব্ধি করতে বাধ্য করেছিলো। পহেলা বৈশাখ উদযাপন হয়ে উঠেছিল একটি আন্দোলন। রমনার বটমূলে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে যে বিদ্রোহের সূত্রপাত ঘটেছিল, তা পেরিয়ে এলো বায়ান্নটি বছর। উল্লেখ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ১৯৭২ সালে পহেলা বৈশাখ কে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেন এবং জাতীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
পাকিস্তানি শাসক থেকে শুরু করে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে যেভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিল ছায়ানট, ২০০১ সালে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা বিস্ফোরণের পরেও ঠিক একই প্রত্যয়ে মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে— ছায়ানট। যেনো প্রত্যয়ের তীব্র বাঁশির সুরে, গানের তাল-লয় বিকিরণের মাধ্যমে মৌলবাদের আস্পর্ধাকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে।
সৃষ্টিলগ্ন থেকেই আমরা জেনে এসেছি- বোধগম্যতার মানচিত্র সৃষ্টি ও মানবিক বিবেকবোধ জাগ্রত করা, একই সাথে হয়রানি মূলক কর্মকাণ্ড, অন্যায়, অবিচার, নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে প্রশ্নাতীতভাবে একত্রিত হয়ে উঠা মহাশক্তির নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বাঙালি যা কিছু অর্জন তার নেতৃত্বের দায়িত্বভার ছিলো বরাবরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁধে। ষাটের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে পহেলা বৈশাখের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা বিরাট সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। তৎকালীন সময় বলা হয়েছিল, পাকিস্তানি আসমান প্রসূত সংস্কৃতির বরখেলাপ করে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির আমদানি হচ্ছে।
পরবর্তীতে, সময়টা যখন ১৯৮৯ সাল। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তখন দেশ জুড়ে। সেই সময় চারুকলা অনুষদের কিছু শিক্ষার্থী একজোট হয়ে পরিকল্পনা করে একই সঙ্গে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করবে এবং প্রতিবাদ জানাবে, প্রতিবাদ জানাতে আয়োজন করবে শোভাযাত্রা। অমঙ্গলের বিরুদ্ধে মঙ্গলের প্রত্যাশায়। যেটি ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেসকো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দেয়। এ মর্যাদা দেওয়ায় আমরা গৌরববোধ করি। পহেলা বৈশাখ কেবল একটি তারিখ নয়, এটি বাঙালির উৎসবের দিন। এই মঙ্গল শোভাযাত্রা যেমন জাগ্রত ছিল সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে তেমনি জাগ্রত রয়েছে মৌলবাদী শক্তির চোখ রাঙানির বিপরীতে প্রতিবাদের জোরালো একটি মাধ্যম হিসেবে। ১৯৮৯ সালে এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল, স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখা হতো। রাষ্ট্র বাধা দিত এ ধরনের আয়োজনে। কিন্তু আমরা সেদিন ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’কে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সামগ্রিক রূপ দিতে পেরেছিলাম।
অত্যন্ত দুঃখের সাথে আমরা দেখতে পাই, মৌলবাদীরা প্রকাশ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার বিরোধিতা করে চলেছে। হেফাজতের ১৪ দফা দাবির ১১ নং দাবিটি ছিলো মঙ্গল শোভাযাত্রাকে নিষিদ্ধ করার দাবি। এমনকি বিবেক-বিক্রিত-বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা বরাবরই চিন্তা-চেতনায় মৌলবাদীদের সমর্থক তাদের অনেকেই মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপটিকে বাঙালি সংস্কৃতির ঐতিহ্য অংশ নয় বলে বিরোধিতা করে। যেটি লজ্জার এবং বেদনার!
পহেলা বৈশাখে আনন্দ শুধুমাত্র এই ব-দ্বীপের সমতলকে উদ্বেলিত করে না; এ আনন্দে উদ্বেলিত হয় পাহাড়ি এলাকার শান্তিকামী মানুষেরাও। রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এবং ময়মনসিংহ ও বৃহত্তর সিলেটের কিছু এলাকার আদিবাসীরা (ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী) উৎসবে মেতে ওঠে বৈশাখের প্রথম দিনে। শুরু হয় দু’দিন আগে, পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে বছরের প্রথম দিনে বরণ করে তারা নতুন বছরকে। বাংলা নববর্ষ আর চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে পালন করা এ উৎসবের নাম বৈসাবি। ত্রিপুরাদের বৈসুক, মারমাদের সাংগ্রাই আর চাকমাদের বিজু নামক ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয়-সামাজিক উৎসবের নামগুলোর আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত এ শব্দটি পাহাড়ি এলাকায় এখন সুপরিচিত উৎসবের নাম। আদিবাসীদের তৈরি হরেক রকম পণ্য নিয়ে বসে মেলা, অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আর তরুণ-তরুণীরা মেতে ওঠে বিভিন্ন রকমের খেলাধুলায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় মারমাদের আয়োজিত ঐতিহ্যবাহী ‘পানিখেলা’। শুদ্ধ মনে একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে পবিত্র করে নেয় নিজেদের। এ এক অপার পবিত্র-শ্বাশত-সুন্দর মুহূর্ত।
হে বাঙালির রক্তিম রঙিন উৎসব বাংলা নববর্ষ, হে বৈশাখ, তুমি এসো স্নিগ্ধ ভোরে ঘুম ভাঙা শিশুর নিষ্পাপ আবেশ নিয়ে, সুন্দর স্বপ্ন নিয়ে, পুরনো ভুল বিশ্বাসকে পেছনে ফেলে, আনন্দময় জীবনের জয়গান হয়ে, সকল অশুভ শক্তিকে বিদায় জানিয়ে। তুমি এসো হে বৈশাখ, বাঙালি নারীর কাজল কালো চোখে জমে থাকা মায়া নিয়ে, তুমি এসো পুরোদস্তুর বাঙালিপনা নিয়ে, লাল আর সবুজের কাঙ্ক্ষিত জয়ধ্বনি ‘জয় বাংলা’ নিয়ে, হে বৈশাখ তুমি চলে এসো, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার স্বর্গীয় ভালোবাসা নিয়ে, হৃদয়ের পবিত্রতা আর উৎসবের প্রতীক হয়ে। এসো হে বৈশাখ, কুসংস্কার ও বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে, আগামী তারুণ্যের সবটুকু প্রাণশক্তি নিয়ে, বৈশাখী শাড়ির আঁচল জুড়ে সারল্যমাখা ভালোবাসা নিয়ে, প্রত্যয়দীপ্ত হৃদয়ে অসীম দেশপ্রেম নিয়ে, মৌলবাদী অপশক্তির কবর রচনা করে, বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার অঙ্গীকার নিয়ে এসো !
তুমি চলে এসো আমাদের স্বপ্ন-সাহস-সংগ্রামে-বিশ্বাসে-আশ্বাসে, নির্মল আনন্দ সঙ্গী করে মঙ্গলের প্রতীক হয়ে।
সবাইকে নববর্ষের প্রীতি ও ভালোবাসা।
মুনেম শাহারিয়ার মুন
সাধারণ সম্পাদক,
স্যার এ.এফ.রহমান হল ছাত্রলীগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।